
প্রকৃতির অন্তরালে এক অনন্ত যাত্রা
শরিফুল ইসলাম
প্রকৃতির বুকে পা রাখতেই মনে হয়, পৃথিবীর সব হাঁটার পথ যেন এখানেই শেষ হয়েছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পড়া সোনালি আলো, পাখির কণ্ঠে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য সুর, আর নদীর কলতান সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য মায়াজাল। এখানে সময়ের কাঁটার তালে তাল মেলানো যায় না। প্রকৃতির ঘড়ি বাজে পাতার মর্মরে, নদীর ঢেউয়ের ছন্দে, আর মেঘের উদাস ভ্রমণে।
কখনো একা বসে থাকি কোনও পাহাড়ের চূড়ায়। নীচে সবুজের সমুদ্র দুলে ওঠে হাওয়ার তালে। মেঘেরা এসে গায়ে লাগায় ভিজে ভিজে পরশ, মনে হয় আকাশটাই যেন নেমে এল মাটির কাছাকাছি। গাছের ডালে ডালে লুকিয়ে থাকা পাতার ফিসফিসানি কানে আসে—যেন প্রকৃতি নিজেই বলছে গোপন কোনো গল্প। এখানে হারিয়ে যাওয়া মানে নিজেকেই খুঁজে পাওয়া। বাতাসের স্পর্শে মিশে যায় সকল ক্লান্তি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবনের সরল রেখা।
মাঠে মাঠে সর্ষে ফুলের হলুদ চাদর, বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ, শরতে কাশফুলের সাদা মিছিল—প্রতিটি ঋতু প্রকৃতিকে নতুন ভাষা শেখায়। কখনো বর্ষার জলে ভিজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কদম ফুল, কখনো শীতের কুয়াশায় ঢেকে যায় সবুজের আয়না। প্রকৃতির এই রূপবদল দেখতে দেখতে মন ভাবে—জীবনও তো এমনই। ক্ষণিকের রূপে অক্ষয় হয়ে থাকে।
সন্ধ্যা নামলে জোনাকিরা জ্বালায় তাদের মিটমিটে লন্ঠন। নক্ষত্রগুলো তখন প্রকৃতির কবিতার মতো ফুটে ওঠে আকাশে। কখনো মনে হয়, এই নদী, পাহাড়, আকাশ—সবই যেন এক অখণ্ড সত্তা। আমরা কেবল তারই অংশ, ক্ষণিকের অতিথি। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া মানে এই বিশালতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। এখানে কোনো প্রশ্ন নেই, নেই উত্তর। আছে শুধু এক অন্তহীন প্রশান্তি, যে প্রশান্তি খুঁজে পায় নিজেরই অন্তর্গত নদী।
প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া হলো আত্মার এক নীরব উৎসব। এখানে হারালেই বোধ হয় জেতা যায়—নিজেকে, নিজের সুপ্ত সত্যকে।